রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৫ অপরাহ্ন
♦ অক্টোবরের আগে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনিশ্চিত
♦ এক বছরে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়েই কাজ চলছে
এম আই ফারুক শাহজী, কালের খবর :
দিন যত গড়াচ্ছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঘিরে জটিলতা ততই বাড়ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই।
বরং পরিচয় যাচাই ফরম রোহিঙ্গাদের নিজ হাতে পূরণ করার শর্ত দিয়ে মিয়ানমার যেন পুরো প্রক্রিয়াটিই নতুন করে শুরু করতে বাধ্য করছে। রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে উৎসাহিত করতে পারত তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের ইতিবাচক ঘোষণা। কিন্তু রোহিঙ্গারা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) না নিলে মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব যাচাই করবে না। আবার রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ, গণহত্যা, হত্যাযজ্ঞ চালানোর জোরালো অভিযোগ উঠলেও মিয়ানমার তা নাকচ করে আসছে।
গত বছর ২৫ আগস্ট মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে নিধনযজ্ঞ শুরু করলে রোহিঙ্গারা নতুন করে দলে দলে আশ্রয় নিতে আসে বাংলাদেশে। এরপর একপর্যায়ে তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছায় মিয়ানমার।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সই করা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিতে গত বছরের আগস্ট থেকে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া আগে সম্পন্ন করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাদ পড়েছে এ দেশে গত ২৫ আগস্টের আগে আশ্রয় নেওয়া তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, কয়েক বছর আগে মিয়ানমার এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই হাজার ৪১৫ জনের পরিচয় যাচাই করে তাদের নাগরিক হিসেবে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল।
কিন্তু মিয়ানমার সেই আশ্বাস রাখেনি। গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ দিকে আসা প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ যে ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে, তাতে আদৌ এ প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে জোরালো শঙ্কা রয়েছে। গত বছরের আগস্ট থেকে আসা রোহিঙ্গারা ফেরত যাওয়ার পর আগে থেকে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি মিয়ানমারের কাছে তোলার সুযোগ আসবে।
ঢাকার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা হতাশার সুরে কালের খবরকে বলেন, ‘কোন ভরসায় রোহিঙ্গারা ফিরবে ? মিয়ানমার কি এখনো এমন কিছু করেছে যে যা দেখে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী হবে ?’
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য সফর করে আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরাও রাখাইন রাজ্যে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন দেখেছেন। রোহিঙ্গারা রাখাইন ছেড়ে আসার পর সেখানে এখন বিরানভূমি। ফসলের ক্ষেতগুলো পড়ে আছে। চাষবাস করারও কেউ নেই।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক আগামী মাসেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আগামী অক্টোবর মাসে এ বৈঠক হতে পারে। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঘিরে অগ্রগতি ও সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত সবাইকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয় না। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সবাই যে ফিরে যাবে, তা বাংলাদেশও মনে করে না। এর পরও তো এ নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ’ ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। কাউকে জোর করে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং তাদের ফিরে যাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) যৌথভাবে রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই করছে। গত বুধবার পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার ৮০০ জনের তথ্য যাচাই করা শেষ হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ইউএনএইচসিআর ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সঙ্গে সম্প্রতি যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে, তা নিয়ে নিজ দেশে সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দাদের বড় একটি অংশই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়াকে সমর্থন করে না।
আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে মিয়ানমারে অং সান সু চির সরকার যে আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিশন গঠন করেছিল সেই কমিশনও এরই মধ্যে ১২ দফা সুপারিশ জমা দিয়েছে। মিয়ানমার টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই পরামর্শক কমিশন গত বছর আনান কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের সুপারিশ করলেও নাগরিকত্ব ইস্যুতে কিছু বলেনি।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের কুইন্স কলেজ গত বুধবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করেছে, মিয়ানমার বাহিনীর নির্মূল অভিযানে রাখাইন রাজ্যে অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযানের নামে ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আগুনে ছুড়ে মারা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা নারী। গুলিতে আহত হয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার রোহিঙ্গা।
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার তথ্য সমন্বয়কারী ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, গত ২১ জুন পর্যন্ত ৯ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে ছয় লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা কুতুপালং বালুখালী ‘বর্ধিত এলাকায়’ আছে। অন্যান্য শিবিরে আছে দুই লাখ ৭৮ হাজার রোহিঙ্গা। এ ছাড়া আরো ১৫ হাজার রোহিঙ্গা স্থানীয় সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে আছে।